বিভিন্ন সময়ে দাতা সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয় কিছু এনজিও বিভিন্ন উপজেলার ১৫-২০টি গ্রাম চারদিকে গার্ডওয়াল দিয়ে সুরক্ষিত করে দিয়েছে। এসব গ্রামগুলোতে আফালে ভিটা ভাঙতে পারেনা। কিন্তু অন্যান্য গ্রামগুলোকে রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। যার ফলে প্রতিবছরই বাস্তুভিটা হারাচ্ছেন দরিদ্র চাষী, মৎস্যজীবী ও শ্রমিকরা।
‘আফাল’ থেকে গ্রাম রক্ষার উদ্যোগ নেই
- আপলোড সময় : ১৩-০৯-২০২৪ ০৯:৩৯:৩৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৯-২০২৪ ০৯:৩৯:৩৭ পূর্বাহ্ন
ছবি: সংগৃহীত
শামস শামীম ::
হাওরের দেশ সুনামগঞ্জ। সরকারি হিসেবে ১৩৩টি হাওর রয়েছে এই জেলায়। ১২টি উপজেলার সবগুলোতেই হাওর রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি উপজেলায় হাওরের সংখ্যা বেশি। প্রাকৃতিক পানির আধার, মিঠাপানির সুস্বাদ মাছ আর ধানের জন্য বিখ্যাত হাওরে রয়েছে নানা প্রজাতির জলজ, স্থলজ, উভচরসহ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র। তবে বর্ষায় পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যাওয়ায় দ্বীপের মতো দেখায় গ্রামগুলোকে। এই সময় হাওরঘেরা বেশিরভাগ গ্রাম ‘আফাল’ (উত্তাল ঢেউ) আঘাত করে। ভেঙে নেয় বসতভিটা। শুকনো মওসুমে আবার এই ভিটায় মাটি ভরাট করেন। এভাবে হাওরের আফালের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন হাওরবাসী। তবে আফাল থেকে গ্রামগুলো রক্ষায় কোনও উদ্যোগ নেই।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ও মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ইসলামপুর, আব্দুল্লাহপুর, মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের ইছাগড়ি, কলাউড়া, তাহিরপুরের জয়পুর, শ্রীলাইন তাহিরপুর, মন্দিআতা, শাল্লা উপজেলার সুলতানপুর, মনুয়া, মোহন খল্লি, শোধন খল্লিসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, এখনো গ্রামগুলোর চারদিকে পানি। তবে পানি কিছুটা কমে আসায় এবং ঝড় তুফান কমে যাওয়ায় এখন আফালের তা-ব নেই। তবে গত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত ঘনঘন বৃষ্টি, ঝড় তুফান এবং হাওরের থৈথৈ পানি হাওরের কৃষকদের কাঁচা ঘরবাড়ির আঙিনা, উঠোন, বসতবাড়ির মেঝে ভেঙে ও ধসিয়ে দিয়েছে। হাওরে পাওয়া যায় এমন প্রাকৃতিক কিছু বন বসতবাড়ির চারদিকে বেড়া দিয়ে কোনওমতে আফাল থেকে ভিটা বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তারা। অনেকে বাড়ির চারদিকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সেখানে বন ফেলে আফাল থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন।
গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবহমান কাল থেকেই তারা হাওরের আফালের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছেন। যারা নিতান্ত অসহায় ও হতদরিদ্র তাদের অনেকের ঘরবাড়ি আফালে বিধ্বস্ত হওয়ায় বাড়িঘর ছেড়ে স্থানান্তরিত হয়েছেন। অনেকে প্রতিবছরই পূর্বপুরুষের ভিটা রক্ষায় শুকনো মওসুমে মাটি দিয়ে ভরাট করেন। আবার বর্ষা এলে ভেঙে যায়। এভাবে তারা লড়াই করছেন। তবে যাদের স্বচ্ছলতা আছে তারা বসতবাড়ির চারদিকে পাকা করে ভিটাকে সুরক্ষিত করেছেন। দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ ও শান্তিগঞ্জের হাওরঘেরা কিছু গ্রাম চারদিকে পাকা করে সুরক্ষিত করেছে বেসরকারি কিছু সংগঠন। তবে সরকারিভাবে গ্রামকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি আজো।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত একাধিক জনপ্রতিনিধির ও অভিজ্ঞজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দাতা সংস্থার মাধ্যমে স্থানীয় কিছু এনজিও শান্তিগঞ্জের দুর্বাকান্দা, শাল্লার মোহনখল্লী, শ্রীহাইল, সুলতানপুর, দিরাই উপজেলার নাসিরপুর, আনোয়ারপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার ১৫-২০টি গ্রাম চারদিকে গার্ডওয়াল দিয়ে সুরক্ষিত করে দিয়েছে। এসব গ্রামগুলোতে আফালে ভিটা ভাঙতে পারেনা। কিন্তু অন্যান্য গ্রামগুলোকে রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। যার ফলে প্রতিবছরই বাস্তুভিটা হারাচ্ছেন দরিদ্র চাষী, মৎস্যজীবী ও শ্রমিকরা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর গ্রামটি চারদিকে দেখার হাওর দ্বারা বেষ্টিত। প্রতি বছর গ্রামটি আফালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবার আফালে গ্রামের মমতাজ বেগমমের কাচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। এখন তার খালার বাড়ি এসে দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
মমতাজ বেগম বলেন, আমাদের স্থানীয় বাড়ি ছিল। আফালে ভাইঙ্গা নিছে ঘরের ভিটা। এখন থাকার উপযোগী না। তাই খালার একটি ভিটায় ভাঙ্গা ঘরে এসে আশ্রয় নিয়েছি। কোনও সহযোগিতা না পাইলে আমাদের মতো মানুষ আবার ভিটা তৈরি করতে পারবেনা। ভিটা রক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি সাহায্য দরকার আমাদের।
একই গ্রামের মৎস্যজীবী সাইদুর রহমান বলেন, পরতি বছর বানালে ঘরের অর্ধেক অংশের মাটি চলে যায়। কার্তিক মাসে আবার মাটি ভরাট করি। পরের বছর আবার ভাঙ্গে। আমরা ভাঙ্গা গড়ার মধ্যেই আছি। গার্ডওয়াল না দিলে আমাদের গ্রামের অস্তিত্ব থাকবেনা।
একই গ্রামের আব্দুল বাতেন বলেন, আমাদের গ্রামটি চারদিকে হাওরঘেরা। বর্ষায় যখন ঝড় আসে তখন হাওরে বড়ো ঢেউ ওঠে। এই ঢেউ দানবের মতো আমাদের বাড়িতে আছড়ে পড়ে। ভেঙ্গে নেয় ভিটা। প্রতি বছরই আমাদের ভিটা ভাংচে। অনেক গরিব মানুষ ভিটা ভরাট না করতে পেরে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
শাল্লা উপজেলার বাহারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বলেন, আমাদের উপজেলায় হাওর বেষ্টিত গ্রাম বেশি। প্রতিটি গ্রামের চারদিকেই হাওর। তাই বর্ষার আফালে প্রতি বছর গ্রামগুলো ভাংছে। হতদরিদ্র মানুষজনের প্রতি বছরের অল্প আয় ভিটা রক্ষার পিছনে চলে যায়। গ্রামগুলোকে আফাল থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেওয়ার দাবি অসহায় মানুষদের।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, বর্ষাকালীন কয়েকমাস হাওরের প্রতিটি গ্রাম দ্বীপের মতো ডুবে থাকে। তখন আফালে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রামগুলো। অনেক গ্রামের ঘরবাড়ি চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। হাওরের গ্রামের বসতভিটা রক্ষায় অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, বর্ষায় হাওরের আফালে গ্রামের ভিটাবাড়ি ধসে যাচ্ছে এ কথা সত্য। তবে আমরা নদী ভাঙ্গন নিয়ে কাজ করি। হাওরের গ্রামগুলো রক্ষায় কোনও প্রকল্প নেই। তবে হাওরের ফসলরক্ষার জন্য আমরা কাজ করি। হাওরের গ্রাম রক্ষার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ